top of page
Writer's pictureSadhguru

কাশী রহস্য ও বিশ্বেশ্বর পর্ব - ১

Aবং হলো ১৯৮০ সাল থেকে তার সাধনার জীবনের নানা কাহিনীকে তুলে ধরা। পূর্ব জীবনকে জানার জন্য অবধূত নানা কাজের সূত্রেও সেই সব জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন সঙ্গে মিলিয়ে নিলেন নিজের জীবনের ছন্দকে।  অবধূতের জীবনের নানা ঘটনাকে তুলে ধরা হবে এই Aবং বিভাগে। অবধূতের প্রথম বারাণসী ভ্রমণ শুরু হয় ১৯৮০ সালে তাঁর গুরু তাঁর বাবা অবধূত আত্মানন্দের হাত ধরে। সেই কাশীর রহস্য এবং তাঁর পরবর্তীতে আবার কাশী যাবার অভিজ্ঞতা কে এখানে তুলে ধরা হলো। অবধূতের নানা জায়গায় ছড়ানো থাকা লেখাকে একত্রিত করে এই লেখা দেওয়া হলো। আশা করা যায় পরবর্তীতে বই আকারে আনা যাবে। তাঁর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এখানে দেওয়া হলো পর্বে পর্বে। আজকে প্রথম পর্ব। 




নমঃ শিবায়। কাশী বা বর্তমান বারাণসী সমগ্র বিশ্বের আধ্যাত্মিক রাজধানী হয়ে উঠেছিল একসময় । এই কাশী যাবার মনস্থ করতেই মনে হলো কেদারনাথ দর্শনও সেরে আসি এই সময়। এখন এপ্রিল মাস। আর কদিন পরে কেদারনাথ মন্দিরের কপাট খুলবে। অক্ষয় তৃতীয়ায়। পয়লা বৈশাখ গেলো। ভাবলাম এবার বেরিয়ে পড়ি।

 

কিন্তু এই বেরোনোর আগে বসে পড়লাম আমার খাতাগুলো নিয়ে। আমার গুরু অবধূত কি বলেছেন, গুরুদেব কিছু বিশেষ জানিয়েছেন কিনা? এসব দেখতে বসে দেখলাম অবধূত বলেছেন বাবা কেদারনাথ দর্শন করতে গেলে আগে কাশীধাম হয়ে যাবে। বাবা বিশ্বেশ্বর মা অন্নপূর্ণার পুজো দেবে সেতো ঠিক আছে কিন্তু কাশীধামে আছেন বাবা গৌরী কেদারেশ্বর। ওনাকে আগে পুজো দেবে। প্রার্থনা জানাবে, অনুমতি নেবে তার পর যাবে কেদারনাথ। তারপর দেখলাম কাশীর কেদারেশ্বর মন্দিরের কথা লেখা আছে যা উনি বলেছেন তা কাশীতে যখন পৌঁছাব তখন বলব।

 

বুঝলাম তার মানে আগে আমায় সেই পরমপাবন কাশীধাম হয়েই যেতে হবে কেদারনাথ। পয়লা বৈশাখের পরের দিন উঠে পড়লাম কালকা মেল্-এ। কালকা বারাণসী যায় না। নামতে হবে তৎকালীন মুঘলসরাই। তাই টিকিটও সেই অনুরূপ হলো। কিন্তু যিনি আমায় এই দর্শনের টিকিট করে দিলেন তিনি আবার টিকিট হাতে ধরিয়ে দিলেন একবারে 2nd AC কোচের। কি বলবো ওনাকে। উচ্চ পদস্থ সরকারি অফিসার। আমি বললাম দাদা আমার তো সীমিত অর্থ। আপনাকে যদি এই কোচের ভাড়া দিতে হয় তো আমার যাওয়াই আর হবে না। আপনি এ কি করলেন! আমি তো স্লীপার কোচের ভাবনা মাথায় রেখে চলছি। সেই মতোই আমার বন্দোবস্ত। এখন আমি কিভাবে মেটাবো আপনার টাকা। তীর্থঋণ রাখতে নেই যে।

 

উনি বললেন, কি বলছেন আপনি, টাকা কে নেবে আপনার থেকে? যাতায়াত সব আমার খরচ। আমি বললাম কেন? উনি বললেন আমি আপনার শ্রীশৈল কাহিনী তো শুনেছি। আমি বললাম তাতে কি? ওই জন্যই আপনার সব ব্যবস্থা আমার। আপনি কাশী যাবেন ওখান থেকে জানাবেন কবে ঋষিকেশ যাবেন। আমি টিকিট পাঠিয়ে দেব। আবার ফেরার পথেও তারিখ জানাবেন। আমি সব বন্দবস্ত করব। আমার কেমন লাগল। বললাম কেন দাদা আপনি আমার এই ঋণে ফেলছেন।

 

উনি বললেন আপনার ভ্রমণকথা শুনব বলে। তার জন্য এতো কিছু। উনি বললেন ছাড়ুন আগে যান। কালকের কালকা মেল্। সেই মতো সব গোছান। ফিরে এলাম ওনার বাড়ি থেকে। কেমন খচখচ করছে মনটা।

 

মনের খচখচানিতে বাসে উঠতে ভুলে গেলাম। হাঁটতে শুরু করলাম রাস্তা ধরে। এতোগুলো টাকা কিভাবে মেটাবো ওনাকে। এসব চিন্তা করতে করতে কখন যে বাড়ি চলে এসেছি। যাই হোক আমার নোটের খাতা পেন এসব নিলাম। দুখানি কম্বল নিয়ে নিলাম। আর সামান্য যা যা প্রয়োজন। এবার ঠিক করেছি ইউনিফর্ম কিনে নেব কাশী গিয়ে। গতবার শ্রীশৈলে যা বিপদে পড়েছি।

 

নেব কি নেব না করে নিয়ে নিলাম গুরুর দেওয়া দূর্গা সপ্তশতী। যাই হোক ওনার টাকার ব্যাপারে মনটি বেশ ভারাক্রান্ত। সন্ধ্যা বেলা এলো আমার ছোটবেলার ডাক্তার বন্ধু ট্রমা স্পেশালিস্ট হুলো। এই হুলো যদিও বিদেশের প্রথিতযশা ডাক্তার কিন্তু আমার কাছে হুলোই।

 

এসে বললো পাহাড়ে যাবি এই ওষুধ পত্র রেখে দে। আর এই টাকাটা তোর কাছে রাখ। তোর মনে হয় লাগবে। আর একটি অতি সুন্দর সোলার এ চার্জ দেওয়া যায় লাইট দিলো। বিদেশী জিনিস। কিন্তু আলোটি বেশ জোরালো।

 

বললাম নানা আমি যেটুকু টাকা নিয়েছি তাতেই হয়ে যাবে। আর আমি মরিবাঁচি তার নেই ঠিক ঋণ শুধব কি করে। তুই বাবা ক্ষেমা দে। বলল না তোকে রাখতেই হবে। এতো মহা সমস্যা। এক জন টিকিট দিলো। একজন আবার এতো গুলো টাকা। নাহ এবার থেকে আর কাউকে কিছু বলে যাবো না। সব একাই করব।

 

চলে গেলো হুলো। স্কন্দপুরাণ-এর কাশী খন্ড নিয়ে বসলাম। কাশী যাবার আগে দেখে নেওয়া। এসব করেই দিনটা কাটিয়ে পরের দিন গুরু স্মরণ করে বেরোলাম বারাণসীর পথে। কালকা মেল প্রায় আটটার সময় ছাড়লো হাওড়া স্টেশন থেকে। সাইড লোয়ার বার্থ আমার। বেশ ভালো টিকিট। দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে। বাড়ি থেকে খাওয়া দাওয়া নিয়েই বেরিয়েছি। কারণ সাত তাড়াতাড়ি খেতে পারিনা। আমার উপরের মানুষটি ও যাবেন বারাণসী। ভাবলাম যাক একটু কথা বলা যাবে। কিন্তু বেশ গম্ভীর মানুষ। তাই আর কথা হলো না। এর মধ্যে আমার একটি ফোন এলো যা আমার এই 2nd AC টিকিটের চিন্তা টা দূর করলো। মনে মনে গুরু কে ধন্যবাদ জানিয়ে বেশ চিন্তা মুক্ত হলাম।

 

টিটি সাহেব এসে টিকিট পরীক্ষা করে গেলেন। জিজ্ঞেস করলাম কখন মুঘলসরাই পৌছাবো? বললেন ৬টা নাগাদ।

 

রাতের খাওয়া খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। কারণ এই ধরণের কোচে কোনো কথা সেভাবে সহযাত্রীদের সাথে হয় না। সবাই নিজের নিজের ল্যাপটপ খুলে বসে আছেন।

 

ভোলানাথকে স্মরণ করে শুয়ে পড়লাম। যা আছে কপালে। সকালে ঘুম ভাঙলো যখন দেখি প্রায় ছটা বাজে। তাড়াতাড়ি উঠে মুখ ধুয়ে এসে বসলাম সিটে। ভোরের আলোয় ভালোই লাগছে। একজন চা বিক্রেতা উঠেছে কোচে। চা নিলাম জিজ্ঞেস করলাম মুঘলসরাই কখন পৌছাবো। বললো মিনিট ১৫র মধ্যে পৌঁছে যাবো। ট্রেন ঠিক টাইমে চলছে।

 

মুঘলসরাই এসে নামলাম। বাজে সাড়ে ছটা। ওভার ব্রিজ দিয়ে ওঠার আগেই কেমন একটা উত্তেজনা অনুভব হলো। আবার দ্বিতীয় জ্যোতির্লিঙ্গ দেখতে পাবো এসব ভেবেই মনে হয় উত্তেজনা। ওভার ব্রিজ থেকে নেমে দেখলাম বিরাট চত্বর। অনেক অটো দাঁড়িয়ে। ডাকাডাকি চলছে। গোধুলিয়া গোধুলিয়া। কত কালের পরিচিত নাম।

 

একজন গেরুয়া ধারী মানুষ বয়স বছর ৬০ কথা বলছেন অটোর সাথে। অটো ২৫০টাকা চাইছে। মানুষটি কে দেখে বাঙালি দেহ ই মনে হলো। পাশে গিয়ে বললাম নমঃ নারায়ণ। আমি যদি আপনার সাথে যাই আপনার আপত্তি আছে। তাহলে টাকাটা ভাগাভাগি করে নিতে পারি। উনি একবার দেখলেন আমায়। বললেন না চলুন। আপনিও কি গোধুলিয়া যাবেন? আমি বললাম হ্যাঁ মহারাজ। আমরা দুজনে বাংলায় কথা বলছি দেখে অটো ড্রাইভার ও বাংলায় কথা বলতে শুরু করলো। বুঝলাম ইনি ও বাঙালি। অটো তে উঠেছি দুজনে।

 

জিজ্ঞেস করলাম মহারাজ কি কাশীতেই থাকেন? বললেন না আমি বীরভূম। অটো বড়ো রাস্তায় এসে পড়লো। বেশ জোরেই যাচ্ছি আমরা।

 

রাস্তার দুধারে দেখছি অবাক বিস্ময়ে। মনে হচ্ছে আমার জীবনে যেন ঘটে যাবে অনেক কিছু। এক নতুন উত্তরণ। এক অনির্বচনীয় উত্তেজনা। নিজেই ভাবছি কি হবে। বোধহয় আমার মুখের ভাব ঘন ঘন বদলাচ্ছিলো। পাশের গেরুয়াধারী বোধহয় আমায় লক্ষ করছিলেন। বললেন বাবা তোমার কি কিছু হয়েছে?

 

এতক্ষন পরে এই প্রথম কথা বললেন। সম্বিৎ ফিরে তাকালাম। বললাম আসলে প্রথমবার বারাণসী আসছি তো তাই হয়ত এত উত্তেজনা হচ্ছে।

 

আমায় জিজ্ঞেস করলেন তা বাবা কি কর তুমি? বললাম ভবঘুরে। ওনার শুনে ঠিক পছন্দ হলো না। বললেন না মানে তোমার পেশা কি? বললাম পেশা কিছু নেই আমি 'যোগীধরা' বলতে পারেন। লোকটা এবার বেশ চোটেই গেল আমার ওপর। মুখাবয়বের এমন চেহারা হলো মনে হলো কেউ ওনাকে নিমের পাঁচন দিয়েছে। মুখটি ঘুরিয়ে নিয়ে উল্টো দিকে চেয়ে রইলেন।

 

অটো ভালোই এগোচ্ছে দেখলাম ব্রীজ আসছে। এবার গেরুধারী জয় মা গঙ্গা বলে প্রণাম ঠুকলেন। বুঝলাম এটি গঙ্গার ওপরের ব্রীজ এটি পার হয়ে বারাণসী ঢুকতে হবে। গেরুয়াধারীর বোধ হয় আবার ইচ্ছা হলো একটু আমায় খোঁচাতে।

 

আমায় বললেন প্রায় এসে গেছি। ব্রীজটা পার হলে আমরা কাশী ক্ষেত্রে ঢুকে যাবো। তা তোমার তো প্রথমবার আসা। কদিন থাকবে? আমি বললাম দেখি তেমন তো কিছু স্থির করে বেরোয়নি। যে কদিন ভালো লাগে থাকব তারপরে হরিদ্বার চলে যাব। উনি বললেন তা ভালো। তাহলে তুমি তীর্থ করতেই বেরিয়েছ। আমি বললাম তা বলতে পারেন।

 

জিজ্ঞেস করলেন তা তোমার কি দীক্ষা হয়েছে। না হলে আমি বা ভালো কোনো গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নিতে পারো। কেন জানি না আমি গেরুয়াধারীদের আলাদা একটা সম্মান করি, কিন্তু এই মানুষটিকে প্রথম থেকেই ভালো লাগছিলোনা। তার কারণ কোথাও একটা অন্য অনুভূতি হচ্ছিলো। আমি বললাম ও আপনি দীক্ষা দেন বুঝি। উনি বললেন দীক্ষা দিই মানে, কত বড়বড় মানুষ আমার শিষ্য। তুমি জানো। অমুক পরিবারের ছোট ছেলে। অমুক ব্যবসায়ী, অমুক ডাক্তার। আমি বললাম ও!, আসলে আমি চিনি খুব কম। সেকি তুমি ওই ডাক্তারকে চেন না, আমি বললাম না, আসলে আমি সারাজীবন বাইরে বাইরেই তো কাটালাম।

 

আমি বললাম তা আপনি কি দীক্ষা দেন বললেন আমি কৃষ্ণমন্ত্র দীক্ষা আর অতি গুহ্য সাধন শেখাই যাদের ভালো বুঝি। আমি বললাম, ও! তা আপনি কি অর্থ নেন? বললেন সে যদি কেউ দীক্ষা নেয় তখন তাকে দেখে বলব। এসব গুহ্য বিদ্যা তো।

 

আমি বুঝলাম আমার মতো করে, সুধী পাঠক তারাও তাদের মতো করে বুঝে নিন।

 

এবার মনে হলো উনি আমায় সেই জটায়ুর স্টাইলে একটু Cultivate করতে চাইছেন। বারবার পা থেকে মাথা অবধি দেখছেন। বললেন আপনি তাহলে কিছুই করেন না। আমি বললাম না। তেমন লেখাপড়া ও শিখিনি আর কি বা করব। ওনার যেন কোথাও একটা সন্দেহ থেকে গেল। বললেন দীক্ষা না নিলে এইসব তীর্থ করে লাভ নেই, দীক্ষা নিয়ে সাধন ভাজন করো কাজে দেবে। আমি বললাম আচ্ছা। তা আপনি উঠছেন কোথায়। বললেন ওনার গুরুভাইয়ের কাশীতে মঠ আছে, সেখানে উঠবেন। হটাৎ দেখলাম ডানদিকে লেখা আছে পাঠানপুরা। অটো এগিয়ে চললো। আমায় বললেন তুমি কোথায় থাকবে? আমি বললাম তার কোনো ঠিক নেই দেখি কোথাও কিছু জুটে যাবে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি আমি কোথাও আগে থাকার জায়গা বুক করে যাইনা। এবার ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একটু পরেই অটো ড্রাইভার আমায় বললো দাদা আপনি কি গোধুলিয়া নামবেন না আগেই নামবেন। আমি বললাম আমি গোধুলিয়া। গেরুয়াধারী বললেন উনি আগে নামবেন তাই জানতে চাইছেন।

 

গোধুলিয়ার একটু আগে একটা গলির মুখে লোকটি নেমে ড্রাইভারের হাতে ১০০ টাকা দিয়েই হনহন করে একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে গেলেন।

 

অটো ড্রাইভারও কিছুই বললো না। একটু খানি যেতে না যেতেই সামনে দেখলাম এক গির্জা। অটো ড্রাইভার বললো দাদা গোধুলিয়া। ১৫০টাকা দিন। আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম ১৫০টাকা আমি কেন দেব? উনি ১২৫ আর আমি ১২৫ এই তো কথা হলো। ড্রাইভার বললো উনি তো আগে নেমেছেন বলে ১০০ টাকা দিয়ে নেমে গেছেন। কাশী পৌঁছতে না পৌঁছতেই কাশীর মহিমার পরিচয় পেলাম। যাই হোক ১৫০টাকা দিয়ে এগোলাম গির্জার দিকে।

 

দেখলাম মাথার ওপর বিরাট বোর্ড-এ লেখা দশাশ্বমেধ ঘাট। বিশ্বনাথ মন্দির। বুঝলাম ঐদিকেই যেতে হবে। হাটঁতে শুরু করলাম। একটু এগোতে বুঝলাম ঠিক দিকেই এগোচ্ছি। এক প্রকান্ড স্তম্ভ তাতে নন্দী মহারাজ বসে আছেন। ডানদিকে পুলিশ সহায়তা কেন্দ্র। সামনে রাস্তা ছোট করার জন্য রোড ব্লকার। এগোলাম। দেখলাম বামদিকে খিচুড়ি বাবার ছোট মন্দির। সেখানে খিচুড়ি বিতরণ হচ্ছে। একটু এগোতেই বাম দিকে দেবগুরু বৃহস্পতির মন্দির। মন্দিরটি দোতলায়। আর একটু এগোতে দেখলাম এক বিশাল তোরণ তার মাথায় আদি শঙ্কর এর মূর্তি। বুঝলাম এই হলো বাবা বিশ্বনাথের গলি। একটু এগোতেই চোখে পড়লো সেই বিখ্যাত বোর্ডিং হাউস। ১০০বছরের বেশি হবে এর বয়স। দশাশ্বমেধ বোর্ডিং হাউস। উল্টো দিকে একটি চায়ের দোকান। তার পাশে একটি তেলেভাজার দোকান। তার গায়ে লাগানো পান সিগারেটের দোকান। চায়ের দোকানে সবাই দেখি বাংলায় বলছে দাদা একটা চা। আমিও যথারীতি চা চাইলাম। পাশে একটি ছোট বেঞ্চ। বসলাম কাঁধের ঝুলি রেখে। চা খাচ্ছি আর চারদিক দেখছি। দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম সস্তায় থাকার জায়গা কোথায় পাব। বললেন ৫০০ টাকার নিচে কিছু নেই। যা কিছু ৫০০ বা তার বেশি। ভাবলাম দেখি আর একটু খোঁজাখুঁজি করে যদি কম পাওয়া যায়। চা খেয়ে আবার ঝোলা নিয়ে ঘাটের দিকে এগোলাম। দেখলাম বড়ো বড় ছাতার নিচে একজন করে পুরোহিত বসে আছেন। বেশিরভাগের সামনেই অনেক লোকজন বসে পিন্ড দেবার পর্ব চলছে। নদীতে জল বেশ কম। নৌকা আছে অনেক। ঘাট বেশ পরিষ্কার পরিছন্ন। একজন নাগাবাবা এক ধারে বসে আছেন গায়ে ভষ্ম মাখা। দেখলাম এক বিদেশী দম্পতিকে, তাঁরা ছবি তুলছেন। তাদের সঙ্গে একজন দেশি গাইড। সে অনেক কিছু বোঝাচ্ছে। এসব দেখে দেখলাম সেই দম্পতি এবার নিজেরাই ঘুরছে। আর গাইডটি একটা ধাপের ওপর বসলো। এক চা ওয়ালা এলো তার কাছে চা দিতে। আমিও গুটিগুটি পায়ে ওই গাইডটির দিকে এগোলাম। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম সস্তায় ঘর পাওয়া যায় কিনা। বা কোনো আশ্রম যদি থাকে যেখানে থাকতে দেয়।

 

আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কথা থেকে আসছি। আমি বললাম কলকাতা, শুনে বললো আমি ত্রিপাঠি, আপনি বাঙালিটোলায় থাকতে পারেন। আমার এক বন্ধু আছে আমি ফোন করছি সে এসে আপনাকে ঘর দেখাবে। আপনার পছন্দ হলে থাকবেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেমন টাকা দিতে হবে বললো কত আর হবে ২৫০-৩০০ টাকা। আমি ভাবলাম যাক তাহলে কম ৫০০টাকার থেকে। বেশ ভালো। আমিও সেই চাওয়ালার থেকে একটি চা নিয়ে ত্রিপাঠীর পাশেই বসে পড়লাম। দেখলাম গাইড ত্রিপাঠি ফোন করছে। যাকে ফোন করছে তার পদবি বোঝা গেল সান্যাল। বসে আছি আমি যথারীতি সিগারেটের প্যাকেট থেকে একখানি নিজের জন্য বার করলাম আর ত্রিপাঠিকেও একটি এগোলাম। ত্রিপাঠি ধন্যবাদ জানিয়ে পকেট থেকে তার সুদৃশ্য বিদেশী লাইটার বার করে সিগারেট ধরালো আমাকেও আগুনটি এগোলো। কিন্তু আমি যেহেতু অন্যের আগুন থেকে সিগারেট ধরাইনা তাই নিজেই ধরালাম ওকে প্রত্যাখ্যান করে।

 

বসে আছি দুজনে। একটু পরে একজন পাজামা ও ফতুয়া পরে বাঙালি ভদ্রলোক এলেন। বয়স আন্দাজ ৩০হবে। ত্রিপাঠীর সাথে কথা বললো। ত্রিপাঠি আমাকে দেখালো। ভদ্রলোক আমার দিকে চেয়ে দুহাত তুলে নমস্কার বলে বলল আমি সান্যাল। আমিও প্রতি নমস্কার করলাম। সান্যাল জিজ্ঞেস করলেন আপনার থাকার জন্য ঘর লাগবে? আমি বললাম হ্যাঁ। আমায় বললেন কজন থাকবেন। আমি বললাম আমি একা কলকাতা থেকে এসেছি। তাই। আপনার ঘরের ভাড়া কেমন? বললেন ২৫০টাকা। আমি মনে মনে ভাবলাম তাহলে তো বেশ কম। ৫০০টাকার অর্ধেক। আমি বললাম আমি আগে একটু ঘরটা দেখবো। এই যখন কথোপকথন হচ্ছে দেখছি সান্যাল ব্যক্তিটি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে না। কেন জানিনা কোনো ভাবেই eye contact এ আসতে চাইছে না। আমি খুব ভালো করে ওর চোখ টা দেখার চেষ্টা করছিলাম। বুঝতে চেষ্টা করছিলাম। কেমন যেন লাগছিলো আমার। একবার চোখে চোখে হতেই আমার সন্দেহটা আরও গাঢ় হলো।

 

আমি জিজ্ঞেস করলাম তা আপনার বাড়িটি কোথায় উনি বললেন বাঙালি টোলায়। ত্রিপাঠি বললো আপনি ওর সাথে গিয়ে দেখে নিন। ও আমায় অনেক বার বলে যাত্রী থাকলে জানাতে। তাই আপনাকে বললাম। এছাড়া আপনি হোটেলে ও থাকতে পারেন। আপনার খুশি। দেখলেই যে থাকতে হবে এমন নয়।

 

আমি বললাম সান্যালকে চলুন দেখি। হাটতে শুরু করলাম সান্যাল এর সাথে। ঘাটের কাছেই একটি বাজার। তার পাশ দিয়ে সান্যাল ঢুকলো একটা গলি। সেই আমাদের উত্তর কলকাতা মার্কা গলি তস্য গলি। যাচ্ছি। সান্যাল সব সময় আমার থেকে একটা দূরত্ত্ব রেখে চলছে। আমার সন্দেহটা আরও গাঢ় হচ্ছে। একটু পরে আমি বাধ্য হয়ে বললাম এত ভেতরে হলে আমার হবে না। আর আমি এতো ভেতরে থাকবো না।

 

সান্যাল মাথাটা ঘুরিয়ে একবার আমায় দেখলো। অদ্ভুত সে চোখের হাসি। হটাৎই আমার অনুভূতি হলো গুরু আমার পাশে দাঁড়িয়ে । আর সান্যাল এর চোখ অদ্ভুত রকম পৈশাচিক লাগলো। সান্যাল আমায় বললো এই এসে গেছি বলেই একটা দোকানের পাশ দিয়ে বাম দিকে একটা দোতলা বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। আমায় ডাকলো না। আমি কি মনে করে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম দরজা দিয়ে ভেতরে আর ঢুকলাম না।

 

গলির আর এক দিক থেকে লম্বা উচ্চতা ঋজু এক ভদ্রলোক বয়স আন্দাজ ৭০, আসছিলেন, বুঝলাম সদ্য গঙ্গায় স্নান সেরে ফিরছেন। সিক্ত শুভ্র বস্ত্র গায়ে। হাতে একটি বাণলিঙ্গ। আমায় বললেন এখানে দাঁড়িয়ে কেন এবং পরিষ্কার বাংলায় বললেন। আমার আবার খটকা লাগলো। বারবার নিজের অনুভূতিতে মনে হচ্ছে আমার গুরুদেব যেন আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। উনি বলতে বলতে এক অপূর্ব সুন্দরী যুবতী দরজা খুলে বেরোলো। সান্যাল এর দেখা নেই। সেই যুবতীকে দেখলে চোখ ফেরানো যাবে না। উচ্চতা বেশ ছোট খাটো। গায়ের রং যেন ফেটে পড়ছে। অপূর্ব মুখাবয়ব। আমি চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি সম্পূর্ণ নীল চোখ। এবার কিন্তু আমার ঘাবড়াবার পালা। আর তার নাক সাধারণ ভাবে অমন নাক যেন কেমন একটা।

 

সেই স্বর্গীয় সুন্দরী এবার এক মায়াবী কণ্ঠে বললো আপনি ভিতরে আসুন। উনি আপনাকে নিয়ে আসতে বললেন ভিতরে। আপনি তো ঘর চাইছিলেন। এই অতিরিক্ত সুন্দরী কে দেখে ও কথা বলার আগেই আমি তাকিয়ে দেখলাম স্নান সেরে আসা বৃদ্ধ ভদ্রলোক ওই ভাবেই দাঁড়িয়ে আছেন।

 

যে বাড়িটির কথা বলছি সেটি ওখানকার অন্যান্য বাড়ির মতোই বেশ প্রাচীন। দেওয়ালে শ্যাওলা। দুচারটে গাছও বেরিয়েছে। আমি খোলা দরজা ও মহিলার দাঁড়াবার পর যেটুকু ফাঁক তার মধ্যে দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি ভিতরটা।

 

কেমন একটা অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে উঠোন। বললাম সান্যাল বাবুকে ডাকুন। কথা বলবো। বলে পাশে দাঁড়ানো সেই বৃদ্ধের দিকে চাইলাম। উনি যেন চোখের ইশারায় কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু পারলেন না। সেই মহিলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওই বৃদ্ধর দিকে চেয়ে আছেন মনে হলো। মহিলা বললেন উনি একটু বেরিয়ে গেছেন আমাকে বলেছেন।

 

কেন জানি না কি খেয়াল হলো বললাম চলুন ঘরটা দেখি। দেখি বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন, আমি ঢুকলাম ভিতরে। মহিলা দরজাটা বন্ধ করবে এমন অবস্থায় আমি বললাম দরজা বন্ধ করতে হবে না, আমি বাইরে থেকে আগে দেখি, চলুন। দরজা খোলাই রইল। হটাৎ চৌকাঠ পেরোবার আগেই আমার ভেতরে শুরু হয়ে গেল শাম্ভবী। বুঝলাম কিছু এখানে আছে। শাম্ভবী শুরু হয়ে চৌকাঠ পেরোতেই দেখলাম শ্যাওলা পড়া একটা উঠোন। তাতে এক কোনে একটি বেলগাছ। তার তলায় একটা পাথর সিঁদুর চর্চিত। একদিকে কিছু একটা প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা। মহিলা আগে আমি পেছনে।


ডানদিকে একটা চওড়া বারান্দা। বারান্দার লাগোয়া ঘর। তার জানালা গুলো বেশ বড়ো বড়ো। বন্ধ সেগুলো। তার ওপর কিছু ছবি। প্রথম ছবিটি দেখেই বুঝলাম একদম কোনো সিদ্ধ তান্ত্রিকের বাড়ি। পর পর তিনটি ছবি। তিনজনই কাশীর বিখ্যাত বাঙালি তান্ত্রিক। যাদের ছবি তাদের কথা আমি শুনেছি সামান্য। ডানদিকের ঘরের দরজা খুললেন ওই মহিলা। আমি আড় চোখে দেখে নিলাম বাইরের দরজা খোলা কিনা। দেখলাম শুধু খোলা নয়, ওই বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে। দরজা খুলে মহিলা একটা সেই পুরোনো ৬০পাওয়ারের বালব জ্বালালেন। দিনের বেলায় ও ঘুটঘুটে অন্ধকার। দেখলাম শাম্ভবী কাজ শুরু করে দিয়েছে পূর্ন মাত্রায়। সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে ডানদিকের ঘরের দিকে এগোলাম। একটা ছোট তক্তপোষ। বিছানা করা। একটি টুল। একটা বহু পুরোনো Calcutta ফ্যান, একটা ছোট টেবিল। গোটা ঘরটায় একটা অদ্ভুত আশঁটে গন্ধ। না এগন্ধ মাছের আশঁটে গন্ধের মতো নয়।

 

আমাকে বললেন দেখুন। আমি ঢুকলাম। মহিলার লাস্য যেন চোখে মুখে ফুটে উঠছে। আমার শাম্ভবীর মাত্রাও বাড়ছে। শরীরী চড়চড় করে গরম হচ্ছে। মহিলা বললো আপনি বসুন আমি আসছি। মহিলা বেরোতেই ঘর থেকে কেমন মনে হলো এক অশরীরী উপস্থিতি ওই ঘরে। চারদিক দেখতে গিয়ে চোখে পড়লো ওই ঘরে যেন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কেউ যেন আমার গলাটা টিপছে। সজোরে উঠে দাঁড়িয়ে এক ছুটে বেরিয়ে এলাম প্রায় লাফ দিয়ে বারান্দা দিয়ে নেমে সোজা দরজার বাইরে গিয়েই ছুটতে শুরু করলাম।

 

বৃদ্ধ আমাকে ধরে ফেললেন হাত টা। খেয়ালি ছিল না উনি যে আমায় দেখছেন, আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। আমি প্রায় হাফাচ্ছি। উনি বললেন আপনি এখানে কেন এসেছেন? উনিও আমার সাথে দ্রুত উল্টো দিকে চললেন। সেই গলি তস্য গলি। কোনদিকে যাচ্ছি জানি না। বললেন আপনি একটু সুস্থ বোধ করছেন। একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন জল খান। আমি দাঁড়ালাম। এতক্ষন উনি আমার হাত ধরে ছিলেন। এবার হাত ছাড়লেন। আমি জলের বোতল ব্যাগ থেকে বার করে গলায় ঢাললাম।

 

আপনি সাধক আমি বুঝেছি, কিন্তু এই বাড়িতে কেন? সব বললাম ওই বৃদ্ধকে। শুনে বললেন আরে এ এক অভিশপ্ত বাড়ি। ওই মহিলা শাকিনী। আপনি নিশ্চই ডাকিনি, শাকিনী, হাকিনী এসব নাম শুনেছেন। তান্ত্রিকদের শাকিনী শক্তি মারাত্মক ক্ষমতা দেয়। এই বাড়িতে যিনি তান্ত্রিক ছিলেন তিনি বাংলারই। কিন্তু তিনি সিদ্ধ হতে না পেরে ক্ষমতার মোহে নিম্ন স্তরের এই বিদ্যায় চলে যান। এই মেয়ের নাম রেখা। ও ওনার পুত্রবধূ। তান্ত্রিক মারা জাবার আগে শক্তিপাত করে ছেলেকে ক্ষমতা দিয়ে গেলেও ছেলের আধার এত ভালো নয়। কারণ তাঁর সাধনা তেমন নয়। এই শাকিনী যা ওর স্ত্রীর মৃতদেহের মধ্যে আছে, সেই ওই ছেলেটিকে শুষে খাচ্ছে। ছেলেটি এখন অর্ধমৃত। ওকে এখন বাঁচার জন্য অন্য কোনো সমর্থ পুরুষ দরকার যে এই শক্তি নিতে বা সহ্য করতে পারবে। বহু আগে এই বাড়িতে নরবলি ও হতো। তাই এবড়ো অভিশপ্ত বাড়ি।

 

আপনি যান আমি আপনাকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে লাহিড়ী মহাশয়ের বাড়ির পাশ দিয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছে দিচ্ছি। আপনি ওখান থেকে ডান দিকে একটু হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন গোধুলিয়া। ওখানে থাকার জায়গা খুজুন। আমি চোষট্টি ঘাট থেকে ফিরছিলাম। আপনাকে দূর থেকে দেখে এবং ওই ছেলের সাথে দেখেই সন্দেহ হয়। দাঁড়িয়ে পড়ি।


অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানালাম ওই বৃদ্ধ কে। আমাকে উনি ওই ভাবে নিয়ে এগিয়ে চললেন। ভিজে গায়ের জল গায়েই শুকাচ্ছে ওনার। আমার জন্য কষ্ট করলেন। এখন এসব ভাবছি। কৃতজ্ঞতায় মনটা ভোরে উঠছে।

 

দেখতে দেখতে পৌছালাম সত্যকাম। লাহিড়ী মহাশয়ের নাতির বাড়ি। এরপর আর একটু এগোতে এলো বাঙালির আর এক মহাপুরুষ লাহিড়ী মহাশয়ের বাড়ির সেই বিখ্যাত দরজা। আমায় বললেন আপনি এই দরজা ছুঁয়ে প্রণাম করুন। আমি একটু অবাক হলাম। কিন্তু করলাম ওনার নির্দেশ মতো। বললাম আচ্ছা ভিতরে যেতে পারবো? বললেন না সেটা পারবেন না। দেখছেন না কতবড় তালা লাগানো। তার পর আমায় নিয়ে আবার এগোলেন। একটু যেন নিচের দিকে নামছি। একটু পরেই দেখলাম বড়ো রাস্তা। এসে আমায় বললেন আপনি কি সুস্থ বোধ করছেন? না আমি আরও এগিয়ে দেব? আমি ওনাকে অনেক কৃতজ্ঞতা জানালাম। বললাম আর আসার দরকার নেই। আপনি যান। আমার জন্য আপনার হয়তো অনেক ক্ষতি হলো। হেসে বললেন না। আমার ভালো লাগছে একটি সৎ কাজে নিজেকে লাগাতে পারলাম। আপনি আসুন। আমি অন্য পথ ধরব।

 

রাস্তায় গোধুলিয়ার দিকে হাঁটা সবে শুরু করেছি। বেজে উঠলো আমার ফোন। দেখি আমার কন্যাসম মার্কিন বান্ধবী ফোন করেছে।

 

ফোন ধরতেই বললো Hey Yogi, this is Rachel. আমি বললাম Hi, I am in Varanasi. Just reached today morning. প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সে বললো Where are you staying there? Go to Zostel Varanasi, near Lxua Police Station. বললাম Thanks a lot. ওপার থেকে ফোন রেখে দিলো রাচেল। আমার কাছে যেন অযাচিত উপদেশ এলো রাচেলের ফোন।

 

একটু এগিয়ে একটা দোকানে জিজ্ঞেস করলাম। লক্সা থানা কোন দিকে, দোকানি বললো আপনি একটি রিক্সা নিন বলুন লক্সা থানা যাবো। ১৫টাকা ভাড়া নেবে।

 

একটি রিক্সা দেখে জিজ্ঞেস করে উঠলাম, দেখলাম গোধুলিয়া এলো তারপর বাম দিকে বেঁকে গেলো। বেশ চওড়া রাস্তা। ততোধিক গাড়ি। সঙ্গে গরু, ষাঁড় সবই চলেছে। একটু পরেই পৌছালাম লক্সা থানার কাছে। একটা তিন মাথার মোড়ে, রিক্সা বলল এই লক্সা। নামলাম। ১৫টাকা ধরিয়ে দিলাম। উলটো দিকে একটি পানের দোকান, তার পাশে একটি ভোজনালায়। পানের দোকানে জিজ্ঞেস করলাম এখানে Zostel বলে কোনো থাকার জায়গা আছে? পানের দোকানির বয়স প্রায় ৬০, আমার মুখের দিকে ভালো করে দেখে বললো বাঙ্গালী? বললাম হ্যাঁ। বললেন কোথা থেকে আসছি? বললাম কলকাতা। শুনে বললেন এই ডানদিকের গলি দিয়ে সোজা যান বেশ খানিকটা গেলে দেখবেন রাস্তাটা সরু হয়ে গেছে। আবার একটু এগোলে ডান দিকে দেখবেন Zostel, পুরোটা ঝরঝরে বাংলায়। বললাম বাঙালি আপনি? বললেন হ্যাঁ। আমি বললাম আপনাকে দেখে তো বোঝা যাচ্ছে না। বললেন তিন পুরুষ হয়ে গেছে এখানে। আরও বললেন চিনতে অসুবিধা হলে বলবেন বিদেশিরা থাকে হোস্টেল। এবার আমার বোধগম্য হলো এটি একটি হোস্টেল।

 

যাই হোক সেই অলি-গলি-পাকস্থলীর মধ্যে দিয়ে এগোলাম ডান দিকে দেখতে দেখতে। পেয়ে ও গেলাম। একটু পরে। একটি পুরোনো বাড়ি। তাতে বড়ো glow sign বোর্ড। লেখা Zostel বারাণসী। ভেতরে ঢুকে দোতালার সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাম দিকে দেখলাম ছোট্ট রিসেপশন। তাতে একটি ছেলে বসে আছে। বছর ২০ বয়স। বেশ হাসি মুখে আমন্ত্রণ জানালো। জিজ্ঞেস করলাম থাকার ব্যবস্থা হবে কিনা? বলল online booking করেছি কিনা? বললাম না আমি তো জানতাম না। রাচেলের কথা বললাম যে সে আমাকে বলেছে। ছেলেটির নাম রাজ। সে এবার বেশ খুশি হয়ে আমায় বলল নিশ্চই তুমি পাবে বেড। ডরমিটরি এখন খালি আছে ৮বেডের। বললাম চলবে। রাজ আমায় আরও উপরে নিয়ে গেল রুমটি দেখাতে। আমি ভেবেছিলাম হোস্টেল একবারে সেই কলেজের হোস্টেলের মতো হবে। দেখলাম না অসাধারণ। আমার সেই কলেজ হোস্টেলের ধারণা সম্পূর্ণ ভেঙে গেল। মাত্র দুজন বিদেশী আছে। তারা আমায় দেখে Hello বললো, আবার নিজেদের কাজে মন দিল।

 

আমি রাজকে বললাম ঠিক আছে আমার চলবে। ইতিমধ্যে মোবাইল আবার বেজে উঠলো দেখি রাচেল। ফোনে কৃতজ্ঞতা জানালাম। বললো সে আমায় একটি কোড পাঠাচ্ছে যাতে আমি কিছু ডিসকাউন্ট পাবো। আমার তো বেশ অবাক হবার পালা। কবে সেই গোয়াতে আলাপ হয়েছিল। ছোট্ট মেয়ে। কত প্রশ্ন আমার সাধনা করা দেখে। এখনো মনে রেখেছে। মেসেজ এসে গেলো। রাজকে বললাম। রাজ বলল এমনি ৩৫০টাকা। ওর কোডের জন্য এই ট্রিপ-এ আমি ২০০টাকা করে দিনপ্রতি বেড পাব। মন তো খুশিতে ভোরে গেলো।

 

রিসেপশন এ এন্ট্রি করছি, রাজ বললো রাচেল হলো গ্লোব ট্রটার। সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। বারাণসী এলে ওখানেই ওঠে। আর ও মাঝে মাঝে এখানে আসে। শুনে বেশ ভালোই লাগলো।

 

সই সাবুদ সেরে গেলাম রুমে। নিচের বেড। বেশ সস্তায় থাকার ব্যবস্থা হলো। ছাদে ওদের roof top লাউঞ্জে ধূমপানের ব্যবস্থা। সঙ্গে একটা ক্যাফেটেরিয়া আছে। ব্যাগ লকারে রেখে গেলাম। একটি সিগারেট ধরিয়ে বসলাম ভাবতে এতক্ষন কি ঘটে গেল। কিন্তু হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিলো মনে। কিভাবে এই রহস্যের সমাধান হবে? ওই বৃদ্ধকে বা কিভাবে পাব? ইসস ওনার নাম যদি জানতাম ঠিকানা টা। একটা কথায় মনে পড়লো চৌষট্টিঘাট ওখানে উনি স্নানে যান। কাল সকালে দেখব। ঘাটে গিয়ে। যদি দেখা পাই।

 

এসব ভাবছি, একটি ছেলে এসে বললো দাদা আমি পান্ডে আগে কলকাতায় থাকতাম, এখানে এখন জব করি। বুঝলাম রাজ ওকে জানিয়েছে। বললাম কোথায় কলকাতা বললো ভবানীপুরে। আলাপ করে চলে গেল।

 

সিগারেটে শেষ টান দিয়ে নিচে এলাম স্নান করার জন্য।


জামা কাপড় কাচার জন্য Zostel এর ওয়াশিং মেশিন আছে। সেখানে ধোয়াধুই করে নিলাম। স্নান সেরে রুমেই বসে গেলাম সাধনায়। আমাকে সাধনায় বসে থাকতে দেখে বাকি দুজন রুম মেট একদম যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। যাতে আমার কোনো অসুবিধা না হয়। খুব ভালো লাগল এমন পরিবেশ পেয়ে। সাধনা সেরে যখন উঠলাম বাজে প্রায় দশটা।

 

রেডি হয়ে বেরোলাম কাল ভৈরব দর্শনের উদ্দেশ্যে। হেঁটেই গেলাম গোধুলিয়া অবধি। ওখানে পুলিশ চৌকিতে জিজ্ঞেস করতে ওরা বললো একটু দূর আছে রিক্সা নিলে সুবিধা হবে। রিক্সা ভাড়া তখন নিলো ৩০টাকা (এখন অবশ্য ৫০টাকা) রিক্সায় উঠে গেলাম। একটু সময় লাগল। বেশ খানিকটা চড়াই। রিক্সাওয়ালা রিক্সা থেকে নেমে টেনে টেনে তুললো।

 

পৌছালাম কাল ভৈরব মন্দির। মূল মন্দিরে ঢোকার আগে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট দোকান। পুজো দেবার উপকরণ নিয়ে সবাই বসে আছে। সেরকমই একটি দোকান থেকে ৫১টাকার একটি ডালি নিলাম। চটি ওখানেই রাখলাম। আমাদের কালীঘাটের মতো ব্যবস্থা। ঢুকলাম ভিতরে। কাল ভৈরব মন্দিরের নাট মন্দিরে দাঁড়িয়ে কাল ভৈরবের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করলাম অবধূত যেমন বলে দিয়েছেন।

 

প্রার্থনা করার সময় অদ্ভুত কিছু অনুভব হলো। কেন হলো বুঝলাম না। প্রার্থনা সেরে নাট মন্দির থেকে নেমে পাশের লাইন দিয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহের দিকে গেলাম। আমার আগে ৫জন আছেন। এক এক করে পুরোহিত পুজো করছেন, আমার পালা এলো পুজো দিলাম। অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে ডানদিকে ঘুরে প্রদক্ষিণ করতে যাব একজন দাঁড় করালেন। দেখলাম একটি উঁচু বেদি মতো। জানিনা কি। দেখলাম কাল ভৈরবের মূর্তি লাগানো।

 

সিঁড়ি দিয়ে উঠলাম। যিনি আটকেছিলেন তিনি ও আমার সাথে উঠলেন। পূজারী। আমায় ওই বেদিটি ছুঁয়ে থাকতে বললেন, কিছু মন্ত্র বলে গেলেন। কিন্তু ওনার উচ্চারণ থেকে বুঝতে পারলাম না কি বললেন। বেশ বড়োসড়ো কিছু বলে গেলেন। তারপর নেমে এবার মাথা নিচু করিয়ে উত্তম মধ্যম পিঠে পড়লো একটি ঝাড়ুর মতো কিছু দিয়ে। আবার শুরু হলো সেই মন্ত্র। তারপর বললেন তোমার যা ইচ্ছা দক্ষিনা দাও। এতো কিছু করে মারধর খেয়ে কি মনে হলো ৫১টাকাই দিলাম তাকে। এবার সে বেশ খুশি হয়ে আবার মাথা নিচু করিয়ে এক বিচিত্র মন্ত্র বলতে লাগলেন। এভাষা আমার কিছুটা পরিচিত।

 

এবার যা বুঝলাম যাতে প্রেত পিশাচ এসব যাতে আমার থেকে দূর হয়। এ পর্ব কিছুক্ষন ধরে চললো। মাথা নিচু করেই আছি। আবার শুরু হলো সেই ঝাড়ু দিয়ে মারধর। লোকটি আমার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললো তুমি কি শশ্মান-এ ঘুরে বেড়াও। আমি বললাম আমি তো সব জায়গায় ঘুরে বেরিয়ে থাকি। বললো মাঝে মাঝে কাল ভৈরব তাহলে ঘুরে যাবে। বললাম ঠিক আছে। শুরু হলো আমার প্রদক্ষিণ। ১১বার প্রদক্ষিণ করে এবার আবার নাটমন্দিরে বসলাম। (এই সময় যা যা করেছি তা এখানে লিখছি না, বইতে থাকবে) শুধু বলে রাখি কাল ভৈরব মন্দিরে কাশী দর্শনের অনুজ্ঞা বা অনুমতি নিতে হয় কাল ভৈরবের থেকে। আর এই স্থানে যদি ইষ্ট মন্ত্র ক্রমাগত জপ করা যায় তো সেই মন্ত্র সিদ্ধ হয়।

 

কাল ভৈরব মন্দিরে প্রণাম করে উঠে ঘুরে নিচে নামছি সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখি এক কালো পোশাক পরা সুঠাম চেহারার মানুষ। গলায় মোটা মোটা দুটো রুদ্রাক্ষর মালা।একটি আঙ্গুলের হাড়ের মালা। পরা। এছাড়াও লাল নীল হলুদ সবুজ হরেক কিসিমের পাথরের মালা মণিবন্ধে, বাহুতে। মাথায় জটা। দাড়ি আছে বেশ বড়ো। হাতে একটা কপাল। দেখলে বেশ ভয়ের উদ্রেক হয়। কিন্তু চোখ দুটি ভারী সুন্দর। বয়স মনে হলো ৫৫-৬০ হবে।

 

দুজনেই দাঁড়িয়ে আছি দুজনের দিকে চেয়ে। আমার দিকে অনেক ক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন নমঃ নারায়ণ। আমিও প্রত্যুত্তরে তাই বলে হাত জড়ো করে নমস্কার করলাম।

 

এবার ওনার মুখে মৃদু হাসি আমার হাতটা ধরে হিন্দিতেই বললেন চল বেটা বলে টানতে টানতে আবার মন্দিরে। আমায় বললেন কাল ভৈরবকো ঠিক সে প্রণাম কর। তেরা পাপ স্খালন কে লিয়ে প্রার্থনা কর। বললাম আমি তো করেছি। বললেন ফির কর। যেভাবে হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে আর কোনো উপায় নেই। অগত্যা আবার করলাম। এবার বললেন একটা কোনা দেখিয়ে ওখানে বসতে।

 

কিছু করার নেই বসলাম। বললেন আঁখে বন্ধ করকে গুরুসে দিয়া হুয়া মন্ত্রআভি জপ শুরু কর। কি মুশকিল। এই তো সব করলাম। মনে মনে ভাবছি এ কি জ্বালা। ওনার দিকেই চেয়ে আছি। বললেন কেয়া সোচ রাহে হো। জো বল রাহা হু ওহী কর। এবার স্বর বেশ কঠিন। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে। পরিস্থিতি কেমন যেন বদলে গেছে। বুঝলাম সবাই এনাকে কমবেশি চেনে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বসে গেলাম গুরু মন্ত্র জপে। বসে ভাবছি সকালে তো এক কান্ড হলো। এখন আবার কি হবে কে জানে। দেখে তো মনে হচ্ছে অঘোরী। যাই হোক মন্ত্র জপ শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষনের মধ্যে বেশ গভীরে পৌছালাম। গর্ভ গৃহের ভিতরের পূজারীর পুজো বা দর্শনার্থীদের ভিড় এসব থেকে যেন আমি ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি। হটাৎই কান বন্ধ হয়ে গেলো। শুরু হয়ে গেলো সমুদ্রের গর্জন। আমি যেন মনে হচ্ছে এক বিশাল সমুদ্রের ধারে আমি একা বসে আছি। খানিকক্ষণ পর আর কিছু মনে নেই। যখন আবার বাইরের শব্দ কানে এলো দেখলাম মাথায় কারো বড়ো হাত রাখা।

 

বললেন আভি উঠ। চল। হাত ধরে টেনে তুলেই বললেন বৈখরী ক্যায়সা লাগা? আমি বলব কি মুখের দিকে চেয়ে আছি। প্রায় টানতে টানতে নিয়ে বেরোলেন মন্দিরের বাইরে সবাই দেখলাম ওনাকে প্রণাম করছেন হাত তুলে। সবার চোখেই বিস্ময় যেন। আমায় নিয়ে মন্দিরের বাইরে এসে বললেন তেরা জুতা লে লে। দোকানে যেখান থেকে ফুল কিনেছিলাম ওখানেই জুতো রেখে ছিলাম। পরে নিলাম। পরে ওনার কাছে আসতেই বললেন ম্যায় অঘোরী বাবা। তু সামমে হরিশ্চন্দ্র ঘাট পে আনা। আমি বললাম কখন। বললেন ৪বাজে আ জানা।


আমি বললাম ঠিক আছে। অঘোরী বাবা কে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গিয়ে রিক্সা ধরলাম গোধুলিয়া যাবো বলে। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে কতকিছু। সকালের সেই শাকিনীর ঘটনা। তারপরেই ঘটে গেলো এই অঘোরীবাবার ঘটনা। এর সঙ্গে আছে অবধূতের নির্দেশ। কখন পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারলাম না। গোধুলিয়া নেমে রিক্সা ভাড়া দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম বিশ্বনাথ মন্দিরের দিকে। গলি তে ঢুকে দেখি কত রকমের দোকান ওই সরু গলির দুপাশে। কিন্তু আমার এখন এতো দেখার অবসর নেই। যেভাবে হোক তাড়াতাড়ি পুজো টা দিতে হবে। বেলাও অনেক হয়েছে। আগে কখনো আসিনি তাই কতটা ঢুকতে হবে বুঝতে পারছিনা। একটি পানের দোকান দেখলাম বাংলায় লেখা জিজ্ঞেস করতে মালিক যিনি তিনি বাংলায় বললেন আজ বিকালে যান। এখন কোনো VIP আছেন। ভালো করে দর্শন হবে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম অন্নপূর্ণা মন্দিরের কথা। বললেন ওখানেও যে বসবেন বলছেন আজ সেটা ভালো করে হবে না। তারচেয়ে সন্ধ্যায় আসুন। মনটা ভার হয়ে গেল। আমায় সব কিছু তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে কারণ এখন থেকে যাবো কেদারনাথ। কপাট খুলবে অক্ষয় তৃতীয়ায়। সময় বেশি নেই। ভাবলাম থাক। আগে কাশীর গৌরী কেদারনাথ ঘুরে আসি। পানের দোকানেই জিজ্ঞেস করলাম তাহলে গৌরী কেদারেশ্বর যাবো কি ভাবে? উনি বললেন এই উলটোদিকে বেরিয়ে একটা বাজার পড়বে ওখানে কাউকে জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দেবে।


বেরিয়ে এলাম বিশ্বনাথ গলি থেকে। উল্টোদিকে বাজারটা দেখেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। আরে এতো সেই বাজার। সকালে এই খানের এক গলি দিয়ে ঢুকে ছিলাম। তাও গুরু স্মরণ করে জিজ্ঞেস করলাম এক চায়ের দোকানে। দোকানদার বললো একটু এগিয়ে যান বাম দিকের রাস্তা ধরুন সোজা কেদার ঘাট পৌঁছাবেন। তার আগেই বাবার মন্দির। দেখলাম সকালের রাস্তা নয়। এই রাস্তা আলাদা।

 

সেই রাস্তা ধরে এগোচ্ছি। রাস্তার দুধারে দোকান। খুব সরু গলি। তার মধ্যে মোটর বাইক, সাইকেল, গরু, ষাঁড়, মানুষ কি নেই। আর রাস্তা আগের সেই গ্রানাইট পাথরে মোড়া কলকাতার ট্রাম লাইনের চেয়েও এবড়ো খেবড়ো। তাতেই দুপাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে দেখছি অনেক বিদেশী বিদেশিনী দল বেঁধে আসছেন বা যাচ্ছেন। একটা ভালো লস্যি আর ক্যাফে দেখলাম। হুঁকো আর গড়গড়া রাখা আছে। ভাবলাম সেই শেষ হোস্টেলে গড়গড়া খেয়েছি। খেয়ে দেখি। ঢুকলাম। দেখলাম সবই মেঝেতে মাদুর তোষক তাকিয়া দিয়ে ব্যবস্থা। কাউন্টার এ কথা বলতেই একদম নিখাদ বাংলায় আপ্যায়ণ হলো। ছেলেটির নাম পৃথ্বীশ। বেনারসে বাড়ি। ভিতরে দেখলাম দুজন বিদেশী পুরুষ বসে আছেন। তারা স্পেনীয় ভাষায় কথা বলছেন। হাতে বড়ো বড়ো লস্যির ভাঁড়। একটি বিদেশিনী মহিলা এক মনে ছবি এঁকে যাচ্ছেন। একটি গদিতে বসে গেলাম তাকিয়ায় হেলান দিয়ে। একটি ছেলে গড়গড়া দিয়ে গেল। টানলাম। খানিক ক্ষণ। খুব সুন্দর গন্ধওয়ালা তামাক।

 

প্রায় মিনিট দশেক বসে উঠে পড়লাম। পয়সা মিটিয়ে চললাম কেদারনাথ মন্দিরের দিকে। দেখলাম ডান দিকে একটা শাঁখারীর দোকান। শাঁখা বিক্রি হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম কেদারনাথ মন্দির আর কত দূর? আঙ্গুল তুলে কোনাকুনি দেখিয়ে দিলেন। দুপা এগিয়ে দেখলাম মন্দিরের মূল দরজা। দুপাশে দুজন বসে আছে ফুল নিয়ে। একজনের কাছ থেকে ফুল মালা এসব নিলাম। সঙ্গে একটু নকুল দানা ও দিয়ে দিলো। ৫০টাকা নিলো। বললো ভেতরে দুধ গঙ্গাজল এসব পাবেন। জুতো ওই দোকানির কাছেই ছেড়ে গেলাম।

 

চৌকাঠে প্রণাম করে ভিতরে ঢুকলাম ঢুকে দেখি বেশ বড় মন্দির প্রাঙ্গন। মেঝেতে নানা ফলক বসানো। তার মধ্যে অনেকই বাংলায় লেখা। বুঝলাম এখানে বাঙালিদের ভালোই আনাগোনা আছে। তাদেরই দেওয়া এসব ফলক। কিন্তু একটু ভালো করে লক্ষ করতেই বুঝলাম না এগুলো অনেক পুরোনো দিনের গল্প। ৫০ থেকে ১০০বছর। বুঝলাম এগুলো সব আগের। এখন আর বাঙালিরা যায় না। ভিতরে দেখলাম কিছু পুণ্যার্থী বুঝলাম এরা সবাই অন্ধ্রের মানুষ। এছাড়াও সকাল থেকেই দেখছি অন্ধ্রের মানুষদের বিশাল লোক জন। সব জায়গা তে। বাঙালিদের বা অন্য প্রদেশ সেভাবে দেখলাম না। দোকান গুলোও প্রথমে ডাকছে তেলেগুতে।

 

ভিতরে ঢুকে বাম দিকে দেখলাম একজন বয়স্ক মহিলা তাঁর ছোট নাতনির সাথে বসে আছেন। ছোট ছোট প্লাস্টিকের গ্লাসে জল, দুধ, এসবের মিশ্রণ। নিলাম একটি। ১০টাকা নিল। জিজ্ঞেস করলাম কেদারনাথের মন্দির টি কোথায়। উনিই দেখিয়ে দিলেন। মহিলা যেখানে বসে তার পিছন দিকে একটি লিঙ্গ দেখলাম ছোট মন্দিরে দেখে বাণলিঙ্গর মতো লাগলো বেশ বড়ো। ভাবলাম প্রথম থেকে দেখি। তার মনে হলো না আমার এবারের মিশন হলো কেদারনাথ। তাই কাশী পরে আলাদা করে আসবো। মানুষের জীবন লেগে যায় কাশীকে বুঝতে তাতেও কাশী অধরা থেকে যায়। এগিয়ে গেলাম কেদারনাথ মন্দিরের দিকে।




 

Comments


Commenting has been turned off.

Share this Page

Subscribe

Get weekly updates on the latest blogs via newsletters right in your mailbox.

Thanks for submitting!

bottom of page