top of page
Writer's pictureSadhguru

জ্ঞানের এক নক্ষত্রর সাথে সাক্ষাতের স্মৃতিকথা

এই ঘটনাটি অবধুতের রহস্যময় আধ্যাত্মিক যাত্রা থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রধানত তার স্ক্রিবল থেকে। সাল ১৯৮০, অবধূত তাঁর গুরু তাঁর বাবার সাথে চলেছেন বাংলার নানা জায়গায়। মূলত তাঁর বাবার পরিচিত সাধকদের সাথে দেখা করতে। সেবারের ঘোরা মূলত সাধুসঙ্গ।



সাল ১৯৮০, অবধূত তাঁর গুরু তাঁর বাবার সাথে চলেছেন বাংলার নানা জায়গায়। মূলত তাঁর বাবার পরিচিত সাধকদের সাথে দেখা করতে। সেবারের ঘোরা মূলত সাধুসঙ্গ। তাঁর সেই স্ক্রিবল প্যাডের লেখা থেকে সংগৃহীত। খুব ভোর ভোর বেরিয়ে নবদ্বীপ হয়ে যখন বোলপুর পৌছালাম তখন বেলা দুপুর। প্রায় দুপুর ২টো। বোলপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে রিক্সা নেওয়া হলো। যাওয়া হলো একটা আদিবাসী গ্রাম পারুলডাঙ্গা। সেখানে এক আদিবাসী শ্মশান সেই শ্মশানে তার সাধন ক্ষেত্র চারদিকে ধানক্ষেত ধূধূ করছে ফাঁকা। শ্মশানের কিছু এদিক ওদিক পোড়া কাঠ পড়ে আছে। সেখানে থাকেন সুধীর ক্ষ্যাপা। সেই সময় তিনি নেই। তাই এদিক ওদিক দেখে যখন তাঁকে পাওয়া গেলোনা, বাবা বললো মাধুকরীতে বেরিয়েছে এখনো ফেরেনি হয়তো। পরে এসে নয় দেখা করা যাবে। রিক্সা ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। ওই রিসাতে উঠে আবার শুরু করা হলো গৌর  হরিবাবার আশ্রমে। তীব্র গরম হলেও হাওয়া দিচ্ছিলো। আমাদের কলকাতার মতো গরম লাগছিলো না। রিক্সা আস্তে আস্তে চলছিল।  খানিকটা যাওয়ার পর এত গরম আর যাওয়া যাচ্ছিলো না। চারদিকে খেঁজুর গাছ সব ন্যাড়া ন্যাড়া।  একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা অশ্বথ গাছের তলায় রিক্সা চালক বললো আর পারছি না।  মাথা কেমন ঘুরছে। আমাদের সঙ্গে জলের বোতল ছিল।  আগে মিলিটারী ওয়াটার বোতল পাওয়া যেত। তাতে বেশ অনেকটা জল ধরতো, সেই জলই সে খেলো। আর একটা কাঁচের বোতলে জল ছিল সেটা সে মাথায় ঢাললো। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে শুরু করলাম শাম্ভবী, রিক্সা চালক একটু পরেই সুস্থ বোধ করলো। আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে ততক্ষণে সাড়ে চারটে বেজে গেছে। 


পৌছালাম গৌরহরি বাবার কাছে। প্রথমে আমি ভেতরে ঢুকলাম। বাবা বাইরে দাঁড়িয়ে। নিচু জানালা তাই বোঝা যাচ্ছিলো না। বাবাকে তখন দেখতে পায়নি কেউ। হাফপ্যান্ট পরা একটা ছেলে ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢুকলো কে? ভেতরে অনেক লোক।  সবাই অবাক। শহরের একটা ছেলে আচমকা ঘরে ঢুকে পড়লো। বললাম আমায় চিনবেন না। তবে আমার বাবাকে চিনবেন। দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাবাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম তখনি সবাই অবাক। বাবাকে দেখে তাঁর কি আনন্দ, গড় জঙ্গলের অনেক কথা আলোচনা হলো। আমরা এখন গড় জঙ্গল থেকে আসছি কিনা সেকথা জিজ্ঞেস করল। ব্রহ্মানন্দ কি একাই তাহলে? এসব কথা হলো।  আরও কত কথা, এসবের পর ওখানে আর কে ছিল? অনেক গান হলো।


তা তোমাকে এই বাউল সাধনা কে করালো? এতো বাবা সহজ সাধনা নয়।  দমের অনেক কাজ আছে? তোমার বয়স কত এতে এতকিছু প্রবীর বলেই সম্ভব। বললাম বাবাই করলো। গৌরহরি বাবা বাবার দিকে একবার তাকালো। বাবা বললো হ্যাঁ।  গৌরহরি বাবা বললেন সব টা। বাবা বললেন হ্যাঁ। সবটা এই বয়সে বলে দিলে। বাবা বললো ও আলাদা রকমের। নিতে পারলো তাই দিয়ে দিলাম। অনেক পদ নিয়ে তত্ত্ব আলোচনা হলো। বাউল সাধনা ও তন্ত্রের অনেক গুপ্ত কথা আর শিবের গুরু এই নিয়েও অনেক কথা হলো। গুরু গোরক্ষনাথ ও নাথ পরম্পরা নিয়েও অনেক কথা হলো। আমার বাবাকে গৌরহরি বাবা বলল তাহলে শেষ পর্যন্ত প্রবীর আবার এলো। ও তো সরে গেলো। বলা ভালো ওই পারমার নোংরামোটা না করলে হয়তো প্রবীর থাকতো। পারমার নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য এতো বড় নোংরামো করলো যে আমাদের সবাই কে সরে আসতে হলো। না হলে কি আজ এই অবস্থা হয় আমাদের। কাকুর কথাও হলো। কাকুর কথা গৌরহরি বাবা ঠিক মনে করতে পারলেন না। আরও অনেক ব্যক্তিগত কথাবার্তা হলো।  বাবার সাধন জীবনের ব্যাপারে অনেক কথা হলো। গৌরহরি বাবা বললেন তাহলে ডাক্তার প্রবীর মাস্টার প্রবীর হয়ে গেলো। বললেন সেই ২০ বছর আগের কথা। তবে প্রবীরকে চিনতে কোনো অসুবিধা হয়নি। একই রকম আছে।


রাত্রে ওখানেই সেবা হবে বারবার করে বলতে লাগলো সুকুমারদাদা। সুকুমার দাদা হলো গৌরহরি বাবার শিষ্য। আমার বাবারও খুব প্রিয় মানুষ। অসাধারণ জ্ঞান কিন্তু বাইরে থেকে কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। সত্যই মাটির মানুষ। বাবা কিছু কিছু সুকুমার দাদার গুণের কথা বলতেই মুখখানা লজ্জায় অধোবনত মুখে লাজুক হাসি। 


গৌরহরি বাবা বললেন তুমি তো শহরের ছেলে তা আমাদের এই খাবার তোমার রুচবে তো? তোমার বাবার নয় সব অভ্যাস আছে? আমি বললাম ডাল, আলুসেদ্ধ, আর ভাত এই আমার কাছে অমৃত। 


নক্ষত্র দাস বাউলের লেখা পদ 

জানা চাই অমাবস্যায় 

চাঁদ থাকে গো কোথায়।  

গগনে চাঁদ উদয় হলে,

দেখা যায় আছে যথায়।। 


অমাবস্যার মর্ম না জেনে 

বেড়াই তিথি নক্ষত্র গুনে 

প্রতিমাসে নবীন চাঁদে 

মরি একি ধরে কায়।।


অমাবস্যার পূর্ণমাসি

কি কর্ম হয় পরে জীগাসি 

যে জানে সে বন মোরে 

মন সুড়াই আজ সে যায়।।


সাতশ নক্ষত্র হয় গান 

সাতি নক্ষত্র যোগ হয় কখন 

না জেনে অধীন নাপন 

সাধক নাম ধরে বৃথায়।। 


সাতটা প্রায় বাজে চারদিকে ঘন অন্ধকার নামছে এর মধ্যেই বাজ পড়া শুরু হলো। তার আগে বেশ ঠান্ডা হাওয়া আসছিলো মনে হচ্ছিলো কোথাও হয়তো বৃষ্টি হয়েছে। একটু পরেই জোরে বৃষ্টি নামলো। চারদিক বেশ ঠান্ডা হয়ে গেলো। অনেক গান অনেক আলোচনা সব হলো। পরের দিন যাবো সকালে বাবার অনেক সাধন বিজড়িত বাউল সম্রাট নবনী দাস বাউলের বাড়ি। গৌরহরি বাবা বললেন গল্পে গল্পে অনেক রাত হলো, এবার শুতে হবে, তোমরা তো কালকে ভোরে আবার বেরোবে। তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। এমনি ভোর বেলায় বেরিয়ে অনেক ঘোরাঘুরি করেছি। ক্লান্ত হয়ে গেছিলাম। 


পরের দিন সকালে সবাইকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এত আদর আপ্যায়ন প্রথম কোথাও গিয়ে পেলাম। মানুষকে কিভাবে আপন করে নিতে হয় জানলাম তখন। 


সুকুমারদার কাছে বিশেষ একটা বায়না হলো।  সেটা মনে ছিলনা প্রথমে বাবাই মনে করিয়ে দিল ব্যাস।  আমাকে বানিয়ে দিতেই হবে। তার সঙ্গে আরও কিছু কন্ডিশন।  আচ্ছা আচ্ছা হবে হবে।  বলেছিল তুমি তো এর পর কোথায় না কোথায় থাকবে তখন আমদের ভুলেই যাবে। বলেছিলাম ভুলে গেলেও আমার গুরু আমাকে ঠিক মনে করিয়ে দেবে। তবে যত দেরিই হোক ওটা আমার চাই।  


ওখান থেকে বেরিয়ে বাস ধরলাম। সিউড়ীর ন'টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম তারপর একটা রাস্তায় ঢুকলাম সেটা মাটির।  গ্রামের রাস্তা চারদিকের  আমাদের দেখতে লোক দাড়িয়ে পড়লো। অবাক হয়ে তারা আমাকে দেখছে। অনেক বাচ্চা বাচ্ছা ছেলে মেয়ে আমাদের পেছনে পেছনে এলো। আমরা নবণী দাস বাউলের বাড়িতে পৌছালাম। চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। একটা ঘরে গেলাম।  সেখানে একটা ফ্রেমে অনেক গুলো ছবি। তাতে একটাতে বাবা আর নবনী দাস বাউল একসঙ্গে আছেন। সবই সাদাকালো ছবি। বাড়ির লোকেদের সাথে অনেক কথা হলো। চা সেবা হলো। বারবার দুপুরের সেবার কথা বলা হচ্ছিলো কিন্তু আমাদের আরও অনেক জায়গায় যেতে হবে বলে বেরিয়ে পড়লাম। আগের দিন রাত্রে খুব বৃষ্টি হয়েছিল বলে এতটা গরম নেই। তাই এতটা কষ্ট হচ্ছিলো না। ওই পথেই আমরা তারাপীঠ যাবো কিন্তু বাবা বললো এক অসাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাই চল। 


সিউড়ীর কাছেই একটা জায়গায় যাওয়া হলো।  সেই মানুষটির নাম নক্ষত্র দাস বাউল। সত্যই সে নক্ষত্র। জ্ঞানের নক্ষত্র। যেমন গান তেমনি তার পদ। তার রচিত দু'একটি পদ ডাইরিতে লিখে নিলাম। অনেকক্ষণ থাকলাম তার ওখানে। দুপুরে সেবা হলো ওখানেই। একটা দারুণ তামাক সাজলো। কি সুন্দর গন্ধ। বাবাকে বললাম একেই কি অম্বুরি তামাক বলে? সেই তামাকের সেবাতেই জানলাম তামাকে নানা গুণাগুণ। অনেক তত্ত্ব আলোচনা হলো। তন্ত্রে তামাকের নানা দিক যা সাধারণ মানুষ জানেও না তাও জানলাম। একটা প্রবাদ বাক্য তেলা মাথায় তেল দেওয়া তাও বোঝালেন এতো সুন্দর ভাবে যার কোনো তুলনা হয়না। বললাম তুমি একবার আমাদের বাড়ি এস কলকাতাতে। তা তুমি কবে যাবে বোলো? বললেন তুমি যখন এতো করে বলছো তা আমি ঠিক পৌঁছে যাবো তোমার বাড়ি।  আমরা হলাম বাউল। পাখির মতো গান গাই আর উড়ে বেড়াই। একদিন উড়তে উড়তে ঠিক তোমার বাড়ি পৌঁছে যাবো।  


তুমি সত্যি পাখি? তুমি তো মানুষ। তুমি কি করে উড়ে উড়ে আসবে। খুব হাসলেন। না না অনেক দূরের পথ তুমি হেঁয়ালি ছাড়ো। আমাদের বাড়ি কি করে আসবে সব বুঝিয়ে দিলাম। লিখে দিয়ে এলাম একটা ছোট স্লিপ প্যাড-এর পাতাতে। তার পদের খাতায় ঢুকিয়ে রাখলো। বললাম মনে করে এস কিন্তু। ৫০টাকা তাকে দিতে চাওয়া হলো যাতায়াত ভাড়ার জন্য কোনো ভাবেই নিলেন না। বললেন আমি মাধুকরীতে যা পাই তাইতেই আমার চলে।  তোমাদের বাড়ীতে যখন মাধুকরী করতে যাবো তখন তুমি দেবে।


বিকাল বেলায় বেরিয়ে পড়লাম কানাই দাস বাউলের ডেরায় যাবার জন্য। রাত্রে ওখানেই থাকবো বলে। 


এর পর অনেক দিন কেটে গেলো নক্ষত্র দাস বাউল আর কলকাতায় আমাদের বাড়িতে আসে না। একদিন মনে পড়তে বাবাকে বললাম নক্ষত্র দাস বাউল তো এলেন না। বাবা বলল এতো দূরে কোনো প্রয়োজন না থাকলে আসবেন কেন? এর মধ্যে দুর্গা পুজো এসে গেলো। স্কুলে পুজোর ছুটি পড়ে গেছে। কালী পুজোর কিছুদিন আগে বাবা বাজার থেকে সবে ফিরেছে, সকাল ৯টা। হটাৎ বাড়িতে নিচে দাঁড়িয়ে ডুবকি বাজিয়ে গান ধরলেন। আমরা সবাই বাড়ির ভিতরে। শনিবার করে আর একজন আসতেন খঞ্জণী বাজিয়ে গান গাইতেন তাঁর গলা তো নয়। এক ছুটে বাড়ীর বাইরে এসে দেখি সেই নক্ষত্র দাস বাউল। বললাম ভেতরে আসুন। কি করে এলেন? ট্রেনে করে? হাসছেন খুব। বললেন একটু জল আনো। আমি তো মাধুকরীতে এসেছি তাই ঘরের ভিতরে যাবো না। তাড়াতাড়ি ভিতর থেকে একটু পাটালি গুড় আর জল নিয়ে এলাম। একটু পরে চা এলো বাবা নিয়ে এলো। আমায় বললেন আমি তো পাখী হয়ে উড়তে উড়তে চলে এলাম। আগের দিন তোমাদের পাশে ওই যে উঁচু নারকেল গাছ ঐখানে ছিলাম। হেঁয়ালী করো না। ততক্ষণে বাবা ঘরের থেকে বেরিয়ে এসেছেন। চাল, আলু, কিছু সবজি আর টাকা দেওয়া হলো। আর উনি বললেন একটু সর্ষের তেল দাও। একটা ছোট্ট ওষুধের বোতল তাতে হয়তো খুব জোর গোগ্রাম তেল ধরবে। তাতে তেল দেওয়া হল। ৫০টাকা দিতে নিলেন না। আমি বললাম আমি যে ৫০টাকা আপনাকে দেব বলেছিলাম। বললেন না। তুমি ১০টাকা দাও। বাবা ১০টাকা দিলো। আর দান দিলে দক্ষিণা দিতে হয় তাই আরও ১টাকা দেওয়া হলো। অনেকক্ষণ ওই বারান্দায় বসে গল্প করলেন। নার ছেলে শংকর তাকে নিয়েও কথা হলো। সে একটা ডেইরি পাবে তাতে কম্পাস আঁকা থাকে ঠিক যেমন আমার ডাইরিতে কম্পাস আঁকা আছে। তাতে যেন ওনার সব পদ লিখে রাখে তাও কথা হলো। আবার তাহলে কবে দেখা হবে? বললেন গানের অনুষ্ঠান হলে আসবো। এই সময় নানা কথায় ওনাকে বললাম যাই হোক ৪২ বছর পরে আবার আপনার বাড়ি যাবো। অবাক হয়ে বললেন নিশ্চই যাবে। বললেন এতো দিন কি বেঁচে থাকবো? বললাম হ্যাঁ আপনার না থাকলেও আমার আপনাকে দরকার আছে।  তাই থাকবেন। বললেন তোমার মনে থাকবে। বললাম আমার গুরু আমাকে ঠিক মনে করিয়ে দেবেন পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। খুব খুশি হলেন।  তবে তারপর অনেক বার দেখা হবে আমাদের। ঠিক দশটা বাজে বললেন তাহলে আমি আজ আসি। আমি সেই ৫০টাকা নিয়ে খুঁতখুঁত করছি। বললাম ঠিক আছে পরে যখন দেখা হবে ১০গুণ বেশি দিয়ে আসবো। খুব বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। আর একটা গান শুনবো।  আরও কিছু পদ বলুন।  কিছুতেই ১০টায় আমি ছাড়লাম না। তারপর সাড়ে দশটা বাজতে ওনাকে ছাড়া হলো।  



Comments


Commenting has been turned off.

Share this Page

Subscribe

Get weekly updates on the latest blogs via newsletters right in your mailbox.

Thanks for submitting!

bottom of page