top of page
Writer's pictureSadhguru

রহস্যময় শ্রীশৈলম - পর্ব ৩

Aবং হলো ১৯৮০ সাল থেকে তার সাধনার জীবনের নানা কাহিনীকে তুলে ধরা। পূর্ব জীবনকে জানার জন্য অবধূত নানা কাজের সূত্রেও সেই সব জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন সঙ্গে মিলিয়ে নিলেন নিজের জীবনের ছন্দকে।  অবধূতের জীবনের নানা ঘটনাকে তুলে ধরা হবে এই Aবং বিভাগে। তাঁর শ্রীশৈলম ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এখানে দেওয়া হলো পর্বে পর্বে। আজকে তৃতীয় পর্ব। 



একটি ছেলে এলো রেসিপশনে ও দিল্লিতে থাকে। ছেলেটি একসাথে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের দর্শনে বেরিয়েছে। ওর আগে থেকে ডবল বেড বুকিং আছে। ওর সঙ্গী আস্তে পারেনি। ও বলল আমি ওর সাথে থাকতে পারি। কড়া চোখে উপরওয়ালা বললো একদম এসব এখানে চলবে না। তাহলে ওর বুকিং ওরা বাতিল করে দেবে। বসে রইলাম রিসেপশন লাউঞ্জে। সন্ন্যাসীকুলও নেই । সন্ধ্যে হয়ে আসছে। শীতকালের বেলা। ঠান্ডা ও লাগছে।

 

উঠে পড়লাম ওদের অফিসের থেকে, রাস্তায় নামলাম। একটু এগিয়ে দেখলাম একটি চায়ের দোকান। চা বললাম । আলাপ জমাবার চেষ্টা করলাম অল্পবয়স্ক দোকানি ছেলেটির সাথে। ও বললো আগে কর্ণাটক সরকারের পরিচালিত একটি হোস্টেল আছে। ওখানে দেখো। ওদের ডরমিটরি আছে। ওরা থাকতে দিতে পারে। এতো যে গাড়ি আসে তার ড্রাইভাররা ওখানে থাকে।

 

দোকানি ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলাম একা থাকতে দেয়না কেন এখানকার গেস্টহাউসে? বললো লোকে এসে আত্মহত্যা করে তাই। শুধু সন্ন্যাসীদের ছাড় আছে। দোকানের কাছ থেকে সরে এলাম। হাঁটা শুরু করলাম সেই দিকে। এসব সময় আমার আবার ধুম্র সাধনের ইচ্ছা জাগে। ডরমিটরির একটু আগে দাঁড়িয়ে একটি সিগারেট ধরালাম। তামাক সেবন তাই সেবা ছাড়া হয় কি করে।  

 

মনে মনে ভাবছি আজ মনে হয় শিবজী মন্দিরে ঠাঁই রেখেছেন। এমন সময় হাজির হলো একটি পুলিশ জীপ্। দাঁড়ালো আমার সামনে। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম একটি বিরাট হোর্ডিঙের নিচে। ড্রাইভারের পিছনে বসা অফিসার আমাকে আপাদ-মস্তক দেখছেন আর ওপরের বোর্ডটি দেখছে। আমিও ওনার দেখা দেখি বোর্ডের দিকে চাইলাম। ওখানকার স্থানীয় ভাষায় কিছু লেখা আছে খুব বড়ো বড়ো করে। যার এক বর্ণ ও আমার বোধগম্য হলো না।

 

অফিসার নেমে এলেন। তারপর তেলুগু তে কিছু বললেন। আমি বুঝলাম না। এরপর বললেন "হিন্দি?" আমি সরাসরি ইংরিজিতে বললাম Nice to meet you. এসব ক্ষেত্রে সাহেবের ভাষা খুব কাজে দেয় আমাদের মতো দেশে। সে বুঝলো আমি হিন্দি ও জানি না।

 

বেশ কড়া গলায় বললো Do you know this devasthanam area is no smoking zone? The fine is rupees five thousand. You are smoking just below the warning board. মুখটা কাঁচুমাচু করে বললাম এমন তো কোথাও দেখিনি। আর আমি কলকাতা থেকে আসছি। তেলুগু জানিনা না। কোনো পিক্টোরিয়াল প্রেসেন্টেশনও তোমার ওই বিল বোর্ডে নেই। কি করে বুঝবো।

 

কলকাতা নামটা যেন বিদ্যুৎ এর মতো কাজ করলো। বললো তুমি কি লেখক? যেন কলকাতার সব মানুষ লেখক? একটু রাগ হলেও বললাম আমি যোগী আর ঘুরে বেড়াই সারা ভারত। আর তা লিখি।

 

শুনে বললো আমি ঠিক বুঝেছি তুমি লেখক ওই কারনে এখানে সিগারেটে খাচ্ছ। কলকাতার লোকেরা খুব ভালো রাইটার। কেমন যেন খাতিরটা বেড়ে গেলো। বললো এখানে দাঁড়িয়ে কেন? আমি বললাম একা বলে কেউ ঘর দিচ্ছে না।

 

বললো তোমার কাছে একটা spare সিগারেট হবে? আমি তো সাদরে দিলাম যদি ৫০০০টাকার ফাইন মকুব হয়। ও ধরালো। বললো সিগারেট খেয়ে তোমায় পুলিশ স্টেশন এ নিয়ে যাবো। ভাবলাম গেলরে। হে মহামৃত্যঞ্জয় মনে মনে এই ছিল তোমার! কেন শুধু শুধু দুষ্টুমি করছো প্রভু। আজ রাত কি তবে থানায় কাটবে? মনে মনে ভাবছি কেন যে ইউনিফর্ম কিনে আনলাম না। এই জন্যই উমাপ্রসাদ বাবু থেকে আমির খান সবাই উনিফর্মের ওপর জোর দিয়েছেন। কালকেই দোকান খুঁজে কিনবো।


এসব ভাবছি, অফিসার জিজ্ঞেস করলো তোমাদের কফি হাউসটা এখনো আছে? আর্টিস্ট, রাইটার, পোয়েট, এরা সবাই আসে ওখানে? কত ফিল্ম ডিরেক্টর আসেন। বেশ খটকা লাগলো। এ ব্যাটা এসব জানলো কি করে? তবে কি এ কলকাতায় ছিল? মল্লিকার্জুন স্বামী কে বললাম সন্যাসী গাঞ্জা খাচ্ছে এখানে তার বেলায় দোষ নেই। তান্ত্রিকরা কারণের বোতল খুলে বসেছে চায়ের দোকানের পাশে তাতে ঝামেলা নেই। আমি নেহাত একটা সিগারেট ধরিয়েছি তাতে এতো ঝামেলা।

 

এসব ভাবছি অফিসার বললো জানো আগে ছোটবেলায় আমরা অনেক দিন কলকাতায় ছিলাম। তাই এসব জায়গায় গেছি। ও যেন কেমন নস্টালজিক হয়ে পড়লো। সিগারেটটা ফেলে বললো চলো দেখি তোমার কোনো থাকার জায়গা ব্যবস্থা করতে পারি কিনা ?

 

সুড়সুড় করে জীপে উঠলাম। পুলিশ স্টেশনে এলো। আমাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। সঙ্গের অফিসার স্টেশন ইনচার্জকে বললো আমি ওর চাইল্ডহুড ফ্রেন্ড। বহু বছর পর দেখা হয়েছে। মল্লিকার্জুন সদনে (ডরমিটরি) একটা রুম ব্যবস্থা করতে হবে। ইনচার্জ যেন লিখে দেয়।

 

আমি তো যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিনা। মনে মনে মহামৃত্যঞ্জয়কে ধন্যবাদ দিলাম। কৃতজ্ঞতার আর ভাষা নেই। বললাম একি লীলা তোমার প্রভু। অফিসার ইনচার্জ টেলিফোন তুলে মল্লিকার্জুন সদনে ফোন করে বলে দিলেন। আমাকে একটা চিরকুটে কিছু লিখে স্ট্যাম্প মেরে দিলেন। বললেন, এখানে যে কদিন আছো কোনো সমস্যা হলে এই কাগজটা দেখিয়ো। তোমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। অফিসার কে বললেন তুমি ওকে পৌঁছে দাও ওখানে। দেখো যেন ভালো রুম দেয়।

 

অফিসার ইনচার্জ বললো বস কফি খাও। সঙ্গী অফিসার বললো আমি লেখক। আমি খুব একটা উচ্চবাচ্য করলাম না। কারন আমি তো লিখিনি তখনও। পকেট থেকে সিগারেটে প্যাকেট বার করে অফিসার ইনচার্জ-এর দিকে এগিয়ে দিলাম। ইতিমধ্যে কফি ও এলো। উনি একটু চারদিক দেখে সিগারেট নিলেন।

 

কফি খেতে খেতে গল্প শুরু হলো। আমি এখানকার পাহাড়ে যাবার জন্য জিজ্ঞেস করতে বললেন যেতে পারো তবে খুব সাবধান। তুমি তো পথ চেনো না। এই ঘন জঙ্গলে পথ হারালে আর দেখতে হবে না। লোকাল গাইড যদি কাউকে পাও তাহলে ভেবে দেখো। তবে না যাওয়াই ভালো। আর জানতো আজও এই অঞ্চলে কাপালিক আছে। যারা নরবলি দেয়। আমি বললাম আজকের দিনেও। বলল হ্যাঁ। তবে এগুলো সবই পাহাড়ে গভীর জঙ্গলে। পুলিশ বা বনদফতরের লোকেরাও এত গভীরে যায় না।

 

কফি শেষ হতে সবাই কে অনেক ধন্যবাদ ও নমস্কার জানিয়ে উঠে পড়লাম। সঙ্গী অফিসার পৌঁছে দিলো ডরমিটরিতে। ভালো একটা ঘর দিলো ২০০টাকা ভাড়া। খুব খুশি হলাম। অফিসার বিদায় নিলো। বাথরুমে গরম জলের ব্যবস্থা আছে। ভালো করে স্নান করলাম। কিছু খেতে হবে। খুব খিদে পেয়েছে। এখন সাতটা বাজে। বেরোলাম একটু। মন্দিরের আগে কয়েকটি খাবার দোকান আছে। সবই গঙ্গাসদনের পরে। ইডলি প্লেট ২০টাকা। তাই বললাম দিতে। খেয়ে যেন একটু শান্তি পেলাম। মল্লিকার্জুন স্বামীকে মনে মনে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। ভাবলাম কৃষ্ণা নদীর দিকে একটু ঘুরে আসি কাল মন্দিরে যাবো। নবরাত্রি চলছে। আজ সপ্তমী ভিড়ও আছে। লম্বা লাইন দর্শনার্থীদের। এগিয়ে গেলাম, বাম দিকে মন্দিরে না গিয়ে সোজা নদীর দিকে।


ঘাটের অনেক আগে থেকে বেশ উঁচু উঁচু সিঁড়ি নিচে নেমেছে। তার আগে প্লাস্টিকের কিছু তাঁবু বা ঘর মতো। কিছু সন্ন্যাসী আছে তাতে। তাদের মন্ত্র পাঠ চলছে। একটি থেকে একজন লাল বস্ত্র পরা তান্ত্রিক বেরোলো সঙ্গে আবার কালো বস্ত্র পরা একজন। দ্বিতীয় জনের বেশভূষা যেন মনে হলো অঘোরীর। হাতে ছিলিম। চারদিক দেখতে দেখতে নিচের দিকে নামতে লাগলাম। ছোট ছোট ডালায় ফুল বিক্রি হচ্ছে সিঁড়িতে সঙ্গে সিঁদুর আর ধূপকাঠি। নামছি নিচে নদীর দেখা নেই। বেশ খানিক পরে নদীর দেখা পেলাম। এটা কার্তিক মাস। অন্ধ্র প্রদেশে খুব পুন্য মাস। কিছু মহিলা জলে কিসব ভাসাচ্ছে। ঘাটটি বেশ চওড়া। একটু সরে দাঁড়ালাম।


মনে মনে ভাবলাম দেহের ভিতর যে শিব, জ্যোতির্লিঙ্গ স্বরূপ আত্মা তা তো দেহ নামক বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত। মনে আবার প্রশ্ন জাগলো নিয়ম বানালে কে? 

 

পোষ্টের আলোতে দেখলাম ডান দিকে একজন বৃদ্ধ মানুষ আসন করে বসে আছেন। উর্ধাঙ্গে কিছু নেই। পরনে একটি সাদা ছোট কাপড়। ওঁর কাছে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম মানুষটি জলের দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে।

 

পাশে গিয়ে বসলাম। নমস্কার করে বললাম নমঃ নারায়ণ। দেখে কেমন ভক্তি জাগে। একটা অনুভব কাজ করতে শুরু করে দিলো। মনে হলো ইনি খুব সাধারণ কেউ নন।


জিজ্ঞেস করলেন এখানে কেন? বললাম জীবনের খোঁজ। হাসলেন বললেন যে সব জানতে বেরিয়েছ তা দেখেছো। বললাম না মহারাজ। আজই এখানে এসেছি মন্দিরে এখনো যাইনি। এখানে এলাম। আপনাকে দেখে তাই কাছে এসেছি। কথাবার্তা এতক্ষন হিন্দিতেই হচ্ছিল। উনি বললেন তীর্থে যখনি যাবে আগে তীর্থ দেবতাকে স্মরণ করে তাঁকে দর্শন ও প্রণাম করো। তারপর সবকিছু। এখন মন্দিরে যাও। ওখানে লঙ্গর আছে। খেয়ে নিও। এখন নবরাত্রি চলছে। তুমি তো জানো এই স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তিপীঠও। তোমার যা দীক্ষা (বলে আমার দীক্ষা মন্ত্রর কথা বললেন) তাই সাধনা করো খানিকক্ষণ ভালো লাগবে। আবারও চমকাবার পালা। আমার দীক্ষামন্ত্র উনি জানলেন কি করে? তাহলে আমার অনুভব যা হয়েছিল তা ঠিক? শিরদাঁড়া দিয়ে এক শীতল স্রোত যেন বয়ে গেলো। মহারাজ বললেন শ্রীশৈলে মল্লিকার্জুন স্বামীর জ্যোতির্লিঙ্গ যেমন আছে তেমনি এটি একটি প্রসিদ্ধ শক্তিপীঠ। দেবী ভ্রামরী রূপে এখানে অবস্থিতা। বললেন যাও দৰ্শন করে এসো। কাল সকালে এসো কথা হবে। আমি এখানে আসবো। নিঃশব্দে উঠে পড়লাম। নমঃ নারায়ণ বলে এগিয়ে চললাম মন্দিরের উদ্দেশ্যে।

 

কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে উঁচু উঁচু সিঁড়ি গুলো ঠেঙিয়ে উঠলাম। পা বেশ ব্যাথা করতে শুরু করলো। তবুও উঠে চললাম। শেষ ৫ধাপের কাছে এসে তখন গলা শুকিয়ে যাচ্ছিলো। প্রায় ১৫০টি সিঁড়ি ততক্ষনে একভাবে উঠে এসেছি। উপর থেকে নামছিলেন একজন, তার কাছে জল চেয়ে খেলাম।মন্দিরের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম দুপাশে সারি সারি দোকান। পুজোর সামগ্রী, খাওয়ারের দোকান, চায়ের দোকান। দাঁড়িয়ে চা আর সিগারেট ধরালাম। এখানে আবার অনেকেই সিগারেটে টান দিচ্ছে। চা খেয়ে একটু ভালো লাগলো। ফুল বেলপাতা আর আকন্দর মালা কিনলাম একটি ছোট বাচ্ছার কাছ থেকে। তার মধ্যে প্যাড়া ও আছে। ৫১টাকা নিলো।

 

মন্দিরের গেটের কাছে জুতো রাখার ব্যবস্থা। ওখানে জুতো রেখে এগোলাম সাধারণের লাইনের দিকে। লাইন বেশ কম। এছাড়া দেখলাম ১০০টাকার লাইন। ১৫০০ টাকার লাইন। সিকিউরিটি কে জিজ্ঞেস করতে বললো ১৫০০ টাকার লাইনে অভিষেক করা যাবে। সব সামগ্রী অফিস থেকে পাওয়া যাবে। তবে তা আগে থেকে বুকিং করতে হবে। ৫০০০ বা ১০০০০টাকার বিশেষ পূজার ব্যবস্থা আছে।


আমি যা টাকা নিয়ে বেরিয়েছি তাতে অভিষেক করা হবে না। মনে মনে শিবকে বললাম কি তোমার খেলা প্রভু। তুমি বৈরাগী তোমায় অভিষেক করতে আবার এতো পয়সা লাগবে? লাইন এগিয়ে চললো। দেখলাম এখানেও সন্ন্যাসীদের বিশেষ ছাড়। তাদের হাতের কমণ্ডলু-এ জল দুধ সব মিশ্রণ আছে।

 

বেশ দ্রুত লাইন এগোচ্ছে কেমন যেন জিলিপির প্যাঁচের মতো ঘোরাচ্ছে জাল দিয়ে ঘেরা জায়গায়, ওখানে আবার চা, জল বিস্কুট কাঁচা ছোলা ভেজানো বা চিপস সবই বিক্রি করছে লোকজন। সরু গলির মতো জায়গা। তারমধ্যে হ্বকার দের আনাগোনা।

 

আমার পিছনে একজন গুজরাট থেকে আসছেন আলাপ হলো। খালি গা। পরনে ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা। কপালে ও বাহুতে ত্রিপুন্ডু আঁকা। বুঝলাম উনি শিবের উপাসক। বললেন জামা খুলে নাও। উর্ধাঙ্গে কিছু যেন না থাকে। প্যান্ট পরে এসেছো কেন? ঢুকতে নাও দিতে পারে। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম ঠিকতো, মহিলা ও শিশুরা ছাড়া বাকি পুরুষদের পোশাক তো একই। আবার চিন্তা শুরু হলো এতো কিছুর পর যদি আটকে দেয়। গুজরাটি ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম এমন কেন? উনি বললেন তুমি কি প্রথমবার কোনো জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন করছো? আমি বললাম হ্যাঁ। বললেন জ্যোতির্লিঙ্গ সম্পূর্ণ অনাবৃত অবস্থায় দর্শন করা নিয়ম, একান্ত না হলে উর্ধাঙ্গ অনাবৃত রাখতে হবে। সেলাই করা কোনো বস্ত্র পরা যাবে না। মনে মনে ভাবলাম দেহের ভিতর যে শিব, জ্যোতির্লিঙ্গ স্বরূপ আত্মা তা তো দেহ নামক বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত। মনে আবার প্রশ্ন জাগলো নিয়ম বানালে কে? 

 

হিমালয় ভ্রমণ নিয়ে অনেক বই পড়েছি, ওমকারেশ্বর নিয়ে ও পড়েছি এমন তো পাইনি কোথাও ভাবছি কোথাও এমন পড়েছি কিনা। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন আমি কোথা থেকে আসছি ? আমি বললাম কলকাতা থেকে। বললেন আগে তোমাদের ওখানে যেটুকু বা এসব চর্চা ছিল এখন আর কিছু নেই। সব কিছু নকল করতে গিয়ে তোমাদের প্রাচীন রীতিনীতিও নেই আবার আধুনিকও সঠিক হয়ে উঠতে পারনি। চায়ের দোকানে শুধু রাজনীতির আলোচনা হয়। মুখে কিছু বললাম না। বয়স্ক মানুষ। বললেন সব বড়ো বড়ো মানুষ তোমাদের ওখানের থেকে তাদের শুধু পুজো করো তাদের রীতিনীতি জানতে চাও না। বেশ রাগ হলো।  শিবের নিয়ম তো শুধু সত্য কথন আর সত্য বচন। আর তো কোনো নিয়ম নেই। না আচার, না বিচার, না উপাচার। শুধু ভক্তি। একটা বেলপাতা দিয়ে ভক্তি ভরে ডাকলেই তাঁকে পাওয়া যায় বেলপাতাটা না থাকলেও মনে ভাবলেও হয়। বাকি নিয়ম তো কিছু নেই। আর যেটা জানি 'শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইন কানুন সর্বনেশে'। আমার বাবা তো আমায় তাই দিয়ে সব করালেন।  মানস পুজো। 

 

লাইন একটু ধীর গতির হলো। একটু পরে থেমেও গেলো। বুঝলাম আটকানো হয়েছে। মিনিট পাঁচেক পর লাইন এগোলো।


একটি গেটের কাছে আটকানো হলো। সিকিউরিটি প্রথমে জিজ্ঞেস করল আমি কোথা থেকে আসছি। বললাম, বললো এই পোশাকে ঢোকা যাবেনা। বললাম এতো দূর থেকে আসছি। ফিরে যাবো দর্শন হবে না।

 

প্রাইভেট সিকিউরিটি। অল্পবয়স্ক একজন ছেলে। বললাম তোমার সিনিয়রকে ডাক। কথা বলি। ডাকলো সিনিয়রকে। বললাম সব কথা। বললো আমাদের কিছু করার নেই এসময়ে অনুমতি পাবো না। দাঁড়িয়ে আছি। কি মনে হলো কোনো একজনকে ডেকে আনলো দেখে পুরোহিত মনে হলো। বললাম সব, পকেট থেকে থানার কাগজটা বার করে দেখালাম। ওটা তেলেগুতে লেখা ছিল। পড়ে কাগজটা আমায় ফিরিয়ে দিলো। তারপর সিকিউরিটি অফিসারকে বললো ওকে ছেড়ে দাও। আমাকে বললো আসো আমার সঙ্গে।

 

নিয়ে গেলো ডানদিকে মূল লাইন থেকে সরিয়ে। একটা ছোট ঘর লোহার গেট দেওয়া। গেটটা খুললো। ভেতরে আলো জ্বলছে। দেখে বুঝলাম এটা সিকিউরিটি দের পোশাক পরিবর্তনের জায়গা। দুটি চেয়ার পাতা। আমাকে বসতে বলে চলে গেলেন। একটু পরে উনি এলেন হাতে একটা সিল্কের ধুতি। আমাকে বললেন পরতে আর জামাকাপড় ওখানে ছেড়ে রাখতে। একজন সিকিউরিটি অফিসারকে দেখতে বললেন ঘরটি আমি বেরিয়ে যাবার পর।

 

মনে মনে গুরুদেবকে স্মরণ করলাম। কৃতজ্ঞতা জানালাম। ধুতি পরে বসলাম ওই চেয়ারটিতে। ভদ্রলোক একটু পরে এসে আমাকে মন্দিরের দিকে নিয়ে চললেন। একটি সরু গেট দিয়ে মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢোকালেন। লাইন দিয়ে যারা আসছেন তাদের দিকে মুখ করে বসালেন। আমার সামনে সেই জ্যোতির্লিঙ্গ। তারপর গর্ভগৃহের মূল দরজা। এই দরজা দিয়ে এক এক করে মানুষ আসছে। জ্যোতির্লিঙ্গের ওপর মাথা ঠেকাচ্ছে শুয়ে পড়ে।

 

শ্রীশৈলতে জ্যোতির্লিঙ্গে মাথা ঠেকাতে দেওয়া হয়। আমি বসে রইলাম। ভদ্রলোক একটি কমন্ডুলু হাতে দিয়ে বললেন অভিষেক করে নিন। দেখে মনে হলো এটিতে জল, ঘি মধু দুধ সিদ্ধি সবই মিশ্রিত । প্রথমে গুরুকে স্মরণ করলাম। তাঁকে প্রণাম করে ধীরে ধীরে সেই জ্যোতির্লিঙ্গতে অভিষেক শুরু করলাম । মনে মনে বলতে লাগলাম পঞ্চাক্ষরী মহামন্ত্র। অভিষেক এর মধ্যে যারা আসছেন দর্শনার্থী তারা প্রণাম করে চলে যাচ্ছেন। কেউ ফুল মালা দিচ্ছেন।

 

অভিষেক করতে করতে একটা শিহরণ অনুভব হচ্ছিলো। মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে যাবো মনে হলো গোটা শরীর থেকে কি যেন একটা নেমে গেলো। শরীরটা একদম হালকা হয়ে গেলো। মন যেন আরো শান্ত। কোনো আন্দোলন সেখানে নেই।

 

মুখ থেকে বেরিয়ে এলো

ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায় কারণত্রয় হেতবে।

নিবেদয়ামি চাত্মানং ত্বং গতি পরমেশ্বর।।

আবারও মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলাম একটা ইলেকট্রিক শক খেলাম যেন। গোটা শরীর ঝনঝন করে উঠলো। প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসলাম।

 

বলে রাখি শ্রীশৈলে জ্যোতির্লিঙ্গের আকার খুব বড় নয়। উচ্চতায় ইঞ্চি আটেক। আমার কাছে থাকা আকন্দের মালা পরালাম। হাতে বেলপাতা নিয়ে জ্যোতির্লিঙ্গর ওপর রেখে গুরুর প্রদত্ত শিবমন্ত্র জপ্ শুরু করলাম। প্রণাম জানিয়ে উঠলাম। ভদ্রলোক পাশে যে দাঁড়িয়ে ছিলেন বুঝিনি। ওনার হাতে কমণ্ডল ফেরত দিয়ে বললাম অনেক ধন্যবাদ। আমার কৃতজ্ঞতার ভাষা নেই। প্রতি নমস্কার করলেন। দুজনে সেই সরু গেট দিয়ে বেরিয়ে এলাম। বললেন ঘুরে ঘুরে দেখুন। ভ্রামরী মাতার মন্দিরে যান। ফেরার সময় ওই ঘরে গিয়ে চেঞ্জ করে নেবেন। সিকিউরিটি থাকবে। কোনো অসুবিধা হলে ওই সিকিউরিটিকে বললে ওনাকে ডেকে দেবে।


পরের পর্বে....




Comments


Share this Page

Subscribe

Get weekly updates on the latest blogs via newsletters right in your mailbox.

Thanks for submitting!

bottom of page